পবিত্র শব-ই-ক্বদরের তাৎপর্য ও ফজিলত
তারাবীহ, সাহারী, ইফতার ও ই'তিকাফের পর রমজানের পঞ্চম অবদান লাইলাতুল ক্বদর বা মর্যাদার রাত্রি। মহানবী (স.) এ রাতটিকে খোঁজার জন্যই একবার একমাস ই'তিকাফ করেছিলেন। যেমন বিখ্যাত সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (স.) রমজানের প্রথম দশকে ই'তিকাফ করেন। তারপর তিনি দ্বিতীয় দশকেও ই'তিকাফ করেন। তারপর তাঁবু থেকে মুখটা বের করে বলেন আমি লাইলাতুল ক্বদর খোঁজার জন্যই রমজানের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে ই'তিকাফ করলাম। তারপর আমাকে বলা হল যে, ঐ রাত শেষ দশকে আছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আরো ই'তিকাফ করতে পছন্দ করে সে যেন আবার ই'তিকাফ করে। ফলে লোকেরা তাঁর সাথে আবার ই'তিকাফ করল। (মুসলিম ১ম খণ্ড- ৩৭০ পৃ:, মিশকাত-১৮২ পৃ: মুসান্নাফ আ: ৪র্থ খণ্ড-২৪৮ পৃ:)
এ হাদীস দ্বারা একটা প্রশ্ন ওঠে যে, লাইলাতুল ক্বদরের এমন কী মাহাত্ম্য আছে যে, যার জন্য প্রিয় নবী (স.) ও তাঁর সাহাবীগণ সুদীর্ঘ একটি মাস নিজেদেরকে আলস্নাহর কয়েদী বানিয়ে সারা দুনিয়াকে ভুলে গিয়ে ঐ রাতের খোঁজে ডুবে থাকলেন? তার উত্তর এই।
বিখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন আলস্নামা ইবনে আবী হাতিম (রহ.) বলেন, একবার রাসূলুলস্নাহ (স.) বণী ইসরাইলের চারজন সাধকের কথা বললেন যে, তাঁরা সুদীর্ঘ আশি বছর ধরে এমনভাবে আলস্নাহর 'ইবাদাত করেছেন যে, চোখের পলক মারার মত সময়ও তাঁরা আলস্নাহর নাফরমানী করেনি। তাঁরা হলেন আইয়ূব, যাকারিয়া, হিযকীল ইবনে অাঁজুয ও ইউশা' ইবনে নূন। কথাগুলো শুনে সাহাবায়ে কিরাম খুবই আশ্চর্যান্বিত হলেন। ফলে নবী (স.) এর নিকট জিব্রাইল (আ.) এলেন এবং বললেন, আপনার উম্মত ঐ সাধকদের আশি বছরের 'ইবাদাতের কথা শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হচ্ছে? তাই আলস্নাহ তা'আলা ওর চেয়েও ভাল জিনিস আপনাদের জন্য নাজিল করেছেন। তা হল সূরা ক্বদর। যাতে বলা হয়েছে যে, লাইলাতুল ক্বদরে মাত্র একটি রাতের 'ইবাদাত এক হাজার অর্থাৎ তিরাশি বছর চার মাসের 'ইবাদাতের চেয়েও উত্তম। এ সুসংবাদ শুনে রাসূলুলস্নাহ (স.) ও সাহাবায়ে কিরাম খুব খুশী হন।
(তাফসীর ইবনে কাসীর ৪র্থ খণ্ড ৫৩১ পৃ:, তাফসীর দুররে মনসুর ৬ষ্ঠ খণ্ড ৩৭১ পৃ:
অন্য বর্ণনায় আছে, একদা নবী (স.)-কে স্বপ্নে পূর্বেকার লোকেদের আয়ু দেখানো হল। যা দ্বারা তিনি বুঝলেন যে, তাঁর উম্মতের আয়ু খুবই কম। সুতরাং এরা সারা জীবন কাজ করলেও ওদের 'আমলের নিকটে পেঁৗছতে পারবে না। তখন আলস্নাহ তা'আলা তাঁকে লাইলাতুল ক্বদর দান করেন যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
(মু'আত্তা মালিক ৯৯ পৃ:, তাফসীর ফতহুল কাদীর ৫ম খণ্ড- ৪৭২ পৃ:, তাফসীর কাবীর ৮ম খণ্ড- ৪৪৪ পৃ:। এ টীকায় মুদ্রিত তাফসীরে আবুস সউদ ৫০১)
কথিত আছে, সুলাইমান (আ.) এবং যুলকারনাইন পাঁচশ' মাস ধরে রাজত্ব করেছিলেন। তাদের ঐসব 'আমলগুলোকে আলস্নাহ তা'আলা ক্বদরে উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য রেখে দিয়েছেন।
(পূর্বোক্ত তাফসীরে কাবীরের টীকা)
লাইলাতুল ক্বদর নাম কেন?
আরবী দাল- বর্ণে জযম দিয়ে কদরুন শব্দের মানে সম্মান ও মর্যাদা। যেমন আলস্নাহ রাব্বুল 'আলামীন নিজেই বলেন:
"তারা আলস্নাহর যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দেয় না।" (সূরা যুমার ৩৯: ৬৭ আয়াত ও সূরা হজ্জ ২২:৭৪ আয়াত)
তাই আবূ বকর অররাক বলেন, এ রাতে মর্যাদাপূর্ণ গ্রন্থ আল কুরআন মর্যাদাবান ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) এর মুখ দ্বারা মর্যাদাশীল উম্মতের (উম্মতে মুহাম্মাদীয়ার) উপর নাজিল হয়েছে। সে জন্য এ রাতটির নাম লাইলাতুল ক্বদর বা মর্যাদার রাত রাখা হয়েছে। আরবী (১) বর্ণে যবর দিয়ে কাদারুন শব্দের অর্থ নির্ধারণ করা, নিরুপণ করা, পরিমাপ করা প্রভৃতি। যেমন আলস্নাহ রাব্বুল 'আরামীন বলেন:
"আমি প্রত্যেক জিনিসই নির্দিষ্ট পরিমাণে নামিয়ে দেই।"
(সূরা হিজর ১৫:২১ আয়াদ)
আলস্নাহ তা'আলা আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে সৃষ্টি জগতের ভাগ্যলিপি লিখে রেখেছেন।
(মুসলিম, মিশকাত ১৯:)
তৎসত্ত্বেও সূরা দুখানের ৪র্থ আয়াতে আলস্নাহ রাব্বুল 'আলামীন বলেন: কুরআন নাজিলের বরকতময় রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, এ বছর থেকে আগামী বছর পর্যন্ত বৃষ্টি ও রুযী এবং আয়ু ও মৃতু্যর পরিমাণ যে কতটা হবে তা এই রাইলাতুল ক্বদরের রাতে নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ পঞ্চাশ হাজার বছর আগে 'লওহে মাহফুজে' যে ভাগ্যলিপি লেখা আছে তাত্থেকে উক্ত বিষয়গুলো এ রাতে ফেরেশতাদের লিপিবদ্ধ করিয়ে দেয়া হয়। সে জন্য এ রাতকে লাইলাতুল ক্বদর বা ভাগ্য নির্ধারণের রাত বলা হয়। (তাফসীরে কাবীর ৮ম খণ্ড ৪৪৩ পৃ:)
যেসব ফেরেশতাদেরকে উক্ত বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব দেয়া হয় ইবনে আব্বাস (রা.)-এর উক্তি মোতাবেক তাঁরা হলেন চারজন-ইসরাফীল, মীকাঈল, জিব্রাঈল ও আজরাঈল। (তাফসীরে কুরতুবী, মা'আরিফুল কুরআন ৮ম খণ্ড-৭৯১-৭৯২ পৃ:)
লাইলাতুল ক্বদর কখন হতে পারে?
লাইলাতুল ক্বদর কখন সংঘটিত হতে পারে এ ব্যাপারে বিভিন্ন বিদ্বানের ছেচলিস্নশটিরও অধিক মত আছে। ঐ সমস্ত অভিমতগুলো হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বর্ণনা করেছেন।
(ফতহুর বারী ৪র্থ খণ্ড ২৬২ থেকে ২৬৬ পৃ:)
অধিকাংশ 'আলেমের মতে ঐ রাতটি রমজান মাসে অনুষ্ঠিত হয়।
(তাফসীরে খাযেন ৭শ খণ্ড ২২৬ পৃ:)
কারণ, আলস্নাহ রাব্বুল 'আলামীন বলেন,
"রমজান সেই মাস, যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে।"।
(সুরা বাকারা ২:১৮৫)
একটি সহীহ হাদীসে আবদুলস্নাহ ইবনে 'ওমর (রা.) বলেন, একদা লাইলাতুল ক্বদর সম্পর্কে রাসূলুলস্নাহ (স.)-কে জিজ্ঞেস করা হল। তখন আমি তা শুনছিলাম। তিনি (স.) বললেন: তা প্রত্যেক রমজানেই হয়। (আবূ দাউদ ১ম খণ্ড-১৯৭ পৃ:, বায়হাকী ৪র্থ খণ্ড ৩০৭ পৃ:)
অন্য বর্ণনায় আছে ইবনে ওমর (রা.)-কে লাইলাতুল ক্বদর সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, ঐ রাত কি রমজানে হয়? তিনি বললেন, তুমি কি আলস্নাহর উক্তিদ্ধ- আমি লাইলাতুল ক্বদরে কুরআন নাজিল করেছি এবং অন্য উক্তি- রমজান সেই মাস যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে পড়নি? (আবদুবনো হুমায়দ, ইবনে জারীর, ইবনে মরদুওয়াহি দুররে মুনসুর ৬ষ্ঠ খণ্ড- ২৭২ পৃ:)
আর এক বর্ণনায় আছে, আবূ যর (রা.) বলেন, আমি রাসূলুলস্নাহ (স.)-কে লাইলাতুল ক্বদর সম্পর্কে বললাম, তা নবীদের ওফাতের সাথে উঠে যায়, না কেয়ামাত পর্যন্ত থাকে? তিনি বললেন, কেয়ামাত পর্যন্ত থাকে। এবার আমি বললাম, তা রমজানের কোন তারিখে হয়? তিনি (স.) বললেন: তোমরা ওকে শেষ দশকে খোঁজ। এরপর আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস কর না।
(মুসনাদে আহমাদ, তাফসীর ইবনে কাসীর ৪র্থ খণ্ড- ৫৩৩ পৃ:)
উক্ত হাদীসগুলো প্রমাণ করে যে, লাইলাতুল ক্বদর রমজানে হয় এবং রমজানের শেষ দশকে হয়। শেষ দশকের ব্যাখ্যায় আর একটু বিশেস্নষণ করে মহানবী (স.) বলেন: তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে তা খুঁজে বেড়াও। (বুখারী ২৭১ পৃ:, মুসলিম ১ম খণ্ড- ৩৭০ পৃ:, মিশকাত ১৮২ পৃ: তিরমিযী ১ম খণ্ড- ৯৮ পৃ: ইবনে মাজাহ- ১২৭ পৃ:)
বিজোড় রাতেরও ব্যাখ্যায় মহানবী (স.) বলেন: লাইলাতুল ক্বদর রমজানের শেষ দশকে বিজোড় রাতে- একুশে রাত, কিংবা তেইশে রাত, অথবা পঁচিশে রাত, নতুবা সাতাশে রাত, কিংবা ঊনত্রিশে রাত, যে ব্যক্তি ঐ রাত গুলি 'ইবাদাতে কাটাবে তার আগেকার সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে জারীর মুহাম্মাদ ইবনে নাসর, বায়হাকী, ইবনে মারদুওয়াহি, দুররে মুনসুর ৬ষ্ঠ খণ্ড- ৩৭২ পৃ:) (মিরকাত ২য় খণ্ড-৫৫৮ পৃ:)
নবী (স.)-এর যুগে একবার লাইলাতুল কদর একুশে রাতে হয়েছিল। (বুখারী ২৭১ পৃ: মুসলিম ১ম খণ্ড- ৩৭০ পৃ:, মিশকাত ১৮২ পৃ:, আবূ দাউদ ১ম খণ্ড- ১৬৯ পৃ:, মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪র্থ খণ্ড ২৪৯ পৃ:)
আবদুলস্নাহ ইবনে উনায়েসের (রা.) বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় যে, একবার নবী (স.)-এর যুগে লাইলাতুল ক্বদর তেইশের রাতে হয়েছিল।
(মুসলিম ১ম খণ্ড ৩৭০ পৃ:, কিয়ামুল লাইল ১০৭ পৃ:)
ইবনে আব্বাস (রা.) রমজানে তেইশের রাতে নিজ পরিবারের উপর পানি ছিটিয়ে দিতেন এবং তাদেরকে ঐ রাতে জাগাতেন। আর এক সাহাবী অবূ যর (রা.) রমজানের তেইশের রাতে কাপড় ধুয়ে খুশবু লাগিয়ে পরতেন, তারপর ঐ রাতে সালাতে দাঁড়াতেন। (কিয়ামুল লাইল ১০৭ পৃ:)
ইবনে আব্বাস (র.) বলেন, একদা রমজানে আমাকে স্বপ্নে বলা হল যে, আজকের রাত ক্বদরের রাত। তখন আমি তন্দ্রালু অবস্থায় দাঁড়ালাম। অতঃপর রাসূলুলস্নাহ (স.)-এর তাঁবুর সাথে সেঁটে গেলাম। তারপর আমি নবী (স.)-এর নিকটে এলাম। তখন তিনি সালাত পড়ছিলেন। এরপর আমি ঐ রাতটার ব্যপারে খোঁজ-খবর নিয়ে জানলাম যে, ওটা ছিল তেইশের রাত। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৩য় খণ্ড- ৭৫ পৃ:, মুসানাদে আহমাদ, তাবারানী কাবীর, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ৩য় খণ্ড- ১৭৬ পৃ:)
উক্ত হাদীসগুলোতে বর্ণিত তিনটি বাস্তব ঘটনা প্রমাণ করে যে, রমজানের একটিমাত্র নির্দিষ্ট রাত সাতাশের রাতে লাইলাতুল ক্বদর অনুষ্ঠিত হয় না। বরং তা কখনো একুশে, কখনো তেইশে, কখনো পঁচিশে, কখনো সাতাশে আবার কখনো ঊনত্রিশে রাতে হয়ে থাকে। এ জন্য এক সাহাবী আবূ কিলাবাহ বলেন, লাইলাতুল ক্বদর রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে পরিবর্তিত হতে থাকে। (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪র্থ খণ্ড- ২৫২ পৃ:)
গ্রন্থনা:
মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী
লাইলাতুল ক্বদরের বৈশিষ্ট্য
ডা. মাহযাবিন রহমান শাওলী
কুরআন ও হাদীস ঘাঁটলে বা বিশেস্নষণ করলে এ রাতের যেসব বিশেষ গুণ ও চিহ্ন পাওয়া যায় তা হল এই:
"এ রাতে কুরআন অবতীর্ণের সূচনা হয়।" (সূরা কাদর : ১, সূরা দুখান :৩ আয়াত) "আমি এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে, আমি তো সতর্ককারী।" (সূরা দুখান ৪৪:৩ আয়াত)
"এ রাতে আলস্নাহ রাব্বুল 'আলামীনের বিশেষ নির্দেশে অগণিত ফেরেশতা ও রুহুল আমীন জিব্রাইল (আ:) অবতরণ করেন এবং ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত এ রাতের প্রত্যেক বিষয় শান্তিময় হয়।" (সূরা কাদর: ৪-৫ আয়াত) সারা যমীনে কাঁকর কুচি যত তার চেয়েও বেশী ফেরেশতা এই রাতে অবতরণ করে। (ইবনে খুযায়মা ৩য় খন্ড ৩৩২ পৃ:, ফতহুল বারী ৪র্থ খন্ড-২৬০ পৃ:)
অন্য বর্ণনায় আছে, আকাশের তারা যত তার চেয়েও বেশী ফেরেশতা অবতরণ। (কিয়ামুল লাইল ১০৮ পৃ:)
ক্বদরের রাতে কী কী করণীয়
মা 'আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলুলস্নাহ (স.) রমজানের শেষ দশকে এত সাধ্য-সাধনা করতেন যে, অন্য সময়ে তা করতেন না। (মুসলিম ১ম খন্ড-৩৭২ পৃ:, তিরমিযী ১ম খন্ড ৯৮ পৃ:, ইবনে মাজাহ ১২৭ পৃ:. মিশকাত ১৮২ পৃ:)
তিনি কেবল একা নন (স.) বরং পরিবারবর্গকেও ঐ 'ইবাদাতে সামিল করতেন। যেমন মা 'আয়েশা (রা.) বলেন, যখন রমজানের শেষ দশক আসতো তখন তিনি নিজে রাত জাগতেন এবং পরিবারবর্গকেও জাগাতেন ও কোমর কষে বাঁধতেন। (বুখারী ২৭১ পৃ:. মুসলিম ১ খন্ড-৩৭২ পৃ: আবূ দাউদ ১ম খন্ড ১৯৫ পৃষ্ঠা, ইবনে মাজাহ ১২৮ পৃ: মিশকাত ১২৮ পৃ:)
'আলী (রা.)-এর হাদীসে আছে যে, ঐ সময় নবী (সা.) তাঁর স্ত্রীদের নিকট থেকেও আলাদা থাকতেন। (বায়হাকী ৪র্থ খন্ড ৩১৪) এবং বিছানাপত্র গুটিয়ে রাখতেন আর এভাবে কাকভোর করে দিতেন। অর্থাৎ এশা থেকে সাহারী পর্যন্ত 'ইবাদাত করতেন (আবূ ইয়ালা, মাজমাউয যাওয়া-য়িদ ৩য় খন্ড ১৪৪ পৃ:)
যায়নাব বিনতে ইন্মে সালামা (রা.) বলেন, রমজানের যখন দশদিন বাকী থাকতো তখন নবী (স.) এর পরিবারের যে কেউ সালাতে দাঁড়াতে সক্ষম হতো তাকে তিনি সালাতে না দাঁড় করিয়ে ছাড়তেন না। (তিরমিযী, ফতহুল বারী ৪র্থ খন্ড- ২৬৯ পৃ:. কিয়ামুল লাইল লিল মারওয়াযী ১০৩ পৃ:, তুহফাতুল আহওয়াযী ২য় খন্ড ৬৯ পৃ:) উক্ত বর্ণনাগুলো প্রমাণ করে যে মহানবী (সা.) রমজানের শেষ দশকে সারা বছরের তুলনায় অনেক বেশী 'ইবাদাত করতেন এবং প্রায় রাতভর নিজে 'ইবাদাতের মধ্যে কাটাতেন ও পরিবারবর্গকেও সালাতে দাঁড় করাতেন। প্রসিদ্ধ তাবেঈ ইবরাহীম নাখয়ী কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। বায়হাকীর বর্ণনা দ্বারা জানা যায় যে, দাঁড়িয়ে ও বসে কররত মু'মিন বান্দাকে এ রাতে জিব্রাইল (আ.) সালাম দেন এবং ফেরেশতারা আর ঐরূপ মু'মিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
লাইলাতুল ক্বদরের বিশেষ দু'আ
'আয়েশা (রা.) বলেন, একদা আমি বললাম, হে আলস্নাহর রাসূল (স.)! আমি যদি জানতে পারি যে, কোন্ রাতটা ক্বদরের তাহলে ঐ রাতে আমি কী বলব? তিনি বললেন, এ দু'আ বলবে:
আলস্না-হুম্মা ইন্নাকা 'আফূওউন তুহিব্বুল 'আফওয়া ফা'ফূ 'আন্নী। "হে আলস্নাহ! তুমি ক্ষমাময়। তুমি ক্ষমা করা ভালবাস। অতএব আমাকে ক্ষমা কর।" (আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিযী, মিশকাত ১৮২ পৃ:, কিয়ামুল লাইল ১০৮ পৃ:, নাসায়ী, বাইহাকী, দুররে মনসুর ৬ষ্ঠ খণ্ড-৩৩৭ পৃ:)
অন্য বর্ণনায় মা 'আয়েশা (রা.) বলেন, আমি যদি জানতে পারতাম যে, কোন রাতটি ক্বদর তাহলে আমার বেশীর ভাগ দু'আ হত- আস আলুলস্না-হুল 'আফওয়া ওয়া 'আফিয়াহ।
"আমি আলস্নাহর নিকট ক্ষমা ও নিরাপত্তা কামনা করছি।"
(মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, দুররে মানসুর ৬ষ্ঠ খণ্ড ৩৭৭ পৃ:)
কা'ব (রা.) বলেন, লাইলাতুল ক্বদরে যে ব্যক্তি তিনবার লা-ইলা-হা ইলস্নালস্না-হ বলবে প্রথমবার বলার জন্য আলস্নাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। দ্বিতীয়বারের জন্য তিনি তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন এবং তৃতীয়বারের জন্য তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর ৪র্থ ৫৩৬ পৃ:, তফসীরে কাবীর, ৮ম খণ্ড-৪৪৬ পৃ:) সুতরাং ক্বদরের রাতে উক্ত দু'আগুলো অধিক মাত্রায় পড়া উচিত।
ক্বদর রাতের মেয়াদ কতক্ষণ
- আব্দুলস্নাহ আল বাকী
ক্বদর ও মর্যাদার রাতের বর্ণনায় কুরআন ও হাদীসে 'লাইলাতুল' শব্দটি ব্যবহূত হয়েছে। সচরাচর 'লাইলাতুন' বলা হয় সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়টাকে। কিন্তু 'লাইলাতুন' এর বহুবচন যখন 'লায়ালী' ব্যবহূত হয় তখন তার অর্থ কখনো দিন-রাত দুইই বুঝায়। যেমন আলস্নাহ রাব্বুর 'আলামীন বলেন:দশ রাতের কসম।
(সূরা ফজর ৮৯: ২ আয়াত)
এখানে লায়ালীন শব্দটির ব্যাখ্যায় মহানবী (স.) বলেন: তা হল, যুলহিজ্জাহ মাসের প্রথম দশদিন। (আহমাদ, ইবনে কাসীর ৪র্থ খণ্ড- ৫০৬ পৃ:, হাকিম, রুহুল মাআ-নী, আমপারা খণ্ড-১১৯ পৃ:)
লাইলাতুন শব্দের দ্বি'বচনেও রাত ও দিন দু'টোই গণ্য করা হয়। যেমন কেউ যদি এ মানত করে যে, সে দু'রাতের জন্য ই'তিকাফ করবে তাহলে সেটাকে দু'রাত ও দিন গণ্য করা হয়।
(তাফসীরে কাবীর ৮ম খণ্ড ৪৪৩ পৃ:, রুহুল মাআনী আমপারা ১৯৩ পৃ:)
তেমনি লাইলাতুল ক্বদরের মধ্যে 'লাইলাতুন' শব্দটির ভেতরে দিনও শামিল কি না? এর উত্তরে এক মহামান্য তাবেঈ আলস্নামা আমের ইবনে শারাহীল শা'বী (রহ) বলেন: অর্থাৎ ক্বদরের দিনটি রাতের মত এবং রাতটি দিনের মত। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা)
এক সাহাবী হাসান ইবনে হুর (রা.) বলেন, ক্বদরের রাত শেষে ফজর উদিত হবার পর জিব্রাইল (আ.) প্রথম উপরে চড়েন এবং তারপর এক এক করে অন্যান্য ফেরেশতাগণ চড়তে থাকেন। তারপর জিব্রাইল (আ.) ও তাঁর সাথীগণ আসমান ও যমীনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সারাটা দিন দু'আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন মু'মিন মু'মিনাদের জন্য এবং যে ব্যক্তি ঈমানের অবস্থায় ও নেকীর আশায় রমজানের সিয়াম রেখেছিল তার জন্যও ফেরেশতারা দু'আ এস্তেগফার করেন। অতঃপর যখন সন্ধ্যা হয় তখন তারা পৃথিবীর নিকটবতর্ী আসমানে প্রবেশ করতে থাকে। (তাফসীর ইবনে কাসীর ৪র্থ খণ্ড-৫৩৬ পৃ:)
এ বর্ণনা দ্বারা পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে, ক্বদরের মেয়াদ এক সূর্যাস্ত থেকে আর এক সূর্যাস্ত পর্যন্ত অর্থাৎ চবি্বশ ঘন্টা।
Source: http://bangladesh-i.com