- লিখেছেন শান্তি প্রিয় ১৮ জুলাই ২০১১
ড. মুহাঃ নজীবুর রহমান : আরবী শা'বান মাসের মধ্যম রজনীকে ‘শবে বরাত' বা ভাগ্য রজনী বলা হয়। ‘শবে বরাত' মুসলিম সমাজে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ইসলামে যার প্রকৃত মর্যাদা সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলিমই পরিপূর্ণরূপে জ্ঞাত নন, তাই বিভ্রান্তি চলছে অনেক। ২৩ হিঃ সালে হযরত উসমান (রাঃ) ৩য় খলিফা-ই-রাশেদা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এ সময় এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইসলামের প্রসার ঘটে। অগণিত মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে বহু মানুষই সাহাবীগণের সাহচার্য থেকে বঞ্চিত ছিলেন, ফলে নওমুসলিমগণের অনেকেই ইসলামের শিক্ষায় দক্ষতা প্রাপ্ত হতে পারেননি। তাঁদের অনেকেরই মধ্যে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা, চরিত্র ও কর্মের পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। তাই নওমুসলিমদের অজ্ঞতা, পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাব, ইসলাম ও আরবদের প্রতি আক্রোশ ইত্যাদির ফলে এদের মধ্যে বিভিন্ন বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইসলামের অনেক শত্রু সামরিক ময়দানে ইসলামের পরাজয় ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে মিথ্যা ও অপপ্রচারের মাধ্যমে ইসলাম ধ্বংসের চেষ্টা করতে থাকে। আর সবচেয়ে কঠিন ও স্থায়ী মিথ্যা, যে মিথ্যা ওহী বা হাদিসের নামে (জাল হাদিস) প্রচারিত হতে থাকে।
এমনি এক দুশমন ছিল আবদুল্লাহ ইবনু সাবা-ইয়ামানের ইহুদী। হযরত উসমানের (রাঃ) খেলাফতকালে সে মুসলমান নাম ধারণ করে ইসলামের ক্ষতি করার জন্য বিভিন্ন শহরে ও জনপদে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক কথা প্রচার করতে থাকে। হিজাজ, বসরা, কুফা ও সিরিয়ায় তেমন সুবিধা করতে না পেরে সে মিসর গিয়ে জাল হাদিস তৈরি করে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকে। অন্যদিকে হিঃ ৪র্থ-৫ম শতাব্দীতে একদল মানুষ যারা নেককার ও দরবেশ বলে পরিচিতি লাভ করে। তারা তাদের অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তির কারণে (সওয়াবের আশায়?) বানোয়াট কথা হাদিসের নামে সমাজে প্রচার করতেন। এদের বাহ্যিক পরহেযগারী, নির্লোভ জীবন যাপন পদ্ধতি দেখে মানুষ সরল মনে এদের কথা বিশ্বাস করে এ সকল বানোয়াট কথা হাদিস বলে গ্রহণ করতো। পরবর্তী সময়ে হাদিসের অভিজ্ঞ ইমামগণ সূক্ষ্ম নিরীক্ষার মাধ্যমে এদের মিথ্যাচার ও জালিয়াতি ধরে ফেলেন এবং তা প্রকাশ করে গ্রন্থ রচনা করেন। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা এ বিষয়ে ‘‘শবে বরাতে’’ সংক্রান্ত প্রকৃত অবস্থা ও এর সঠিক মর্যাদা, পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে আলোচনা করবো। সাথে সাথে সমাজে প্রচলিত বিভ্রান্তির কারণস্বরূপ এ সংক্রান্ত জাল হাদিসগুলোও কিছু আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ।
প্রথমত: ‘শা'বানের মধ্যম রজনী'র বিশেষ ফযিলত : মধ্য শা'বানের রজনীতে সৃষ্টি জীবের প্রতি বিশেষভাবে আল্লাহর ক্ষমা প্রদানের বিষয়টি সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এ সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘‘ইন্নাল্লাহা লাইত্তালিউ ফিলাইলাতিন নিছফিমিন শা'বানা ফাইয়াগফিরু লিজামিয়ি খলক্বিহি ইল্লালি মুশরিকন আও মুশাহিনিন।’’ - ‘‘আল্লাহতায়ালা মধ্য শা'বানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং ‘শির্ককারী' ও বিদ্বেষ-হিংসা পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’’ এই অর্থের হাদিস কাছাকাছি শব্দে ৮ জন সাহাবী আবু বকর সিদ্দিক, আয়েশা, আবু হুরায়রা, আবু মূসা আশ'আরী, মুয়ায ইবন জাবাল, আবদুল্লাহ ইবন আমর, আউফ ইবন মালিক ও আবু সা'লাবা আল-খুশানী (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে বর্ণিত হয়েছে। (ইবন মাযাহ, আস-সুনান ১/৪৪৫, বায্যার, আল-মুসনাদ ১/১৫৭, ২০৭, ৭/১৮৬; আহমদ ইবন হাম্বল, আল-মুসনাদ ২/১৭৬; ইবন আবি আসিম, আস-সুন্নাহ, পৃঃ ২২৩-২২৪; ইবন হিববান, আস-সহীহ ১২/৪৮১; তাবরানী, আল-মু'জাম আল-কাবীর ২০/১০৮, ২২/২২৩; আল-মু'জাম আল-আওসাত, ৭/৬৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, ৩/৩৮১; ইবন খুযায়মা, কিতাবুত তাওহীদ ১/৩২৫-৩২৬)। এ সকল হাদিসের মধ্যে কিছু সনদ দুর্বল ও কিছু সনদ ‘হাসান' পর্যায়ের। সামগ্রিক বিচারে হাদিসটি সহীহ। আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দিন আলবানী (রহঃ) বলেন, হাদিসটি সহীহ যে মূল কথা অনেক সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা পরস্পর একে অপরকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে।... (আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীস আস-সাহীহাহ ৩/১৩৫)।
অত্র হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, শা'বান মাসের মধ্যম রজনীটি একটি ফযিলতপূর্ণ বরকতময় মাগফেরাতের রাত্রি। এই রাতে আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদেরকে (যারা-মুশরিক নন, অংশীবাদী নন, জীবনে সকল ধরনের শির্কমুক্ত এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত জীবনযাপন করেন) ক্ষমা করে দেন। কিন্তু এই ক্ষমা অর্জনের জন্য শির্ক ও বিদ্বেষ বর্জন ব্যতীত অন্য কোন ইবাদত-বন্দেগীর প্রয়োজন আছে কিনা তা অত্র হাদিসে উল্লেখ করা হয়নি।
দ্বিতীয়ত ঃ ‘‘লাইলাতুম্মুবারাকাহ’’ আয়াতের তাফসীর : পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, ‘‘ইন্না আনযালনাহু ফিলাইলাতিম মুবারাকাতিন, ইন্না কুন্না মুনযিরিন।’’ (সূরা : ৪৪ দুখান, আয়াত-৩)। ‘‘আমি তো তা (আল-কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এক মোবারক রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী।’’
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় শুধুমাত্র তাবিয়ী ‘ইকরিমাহ' বলেন, এখানে ‘মোবারক রজনী' বলতে ‘মধ্য শা'বানের রাত্রিকে বুঝানো হয়েছে। ইকরিমাহ আরও বলেন, অত্র রাতে গোটা বছরের সকল বিষয়ে ফায়সালা করা হয়। (তাবারী, তাফসীর ২৫/১০৭-১০৯)।
কিন্তু প্রখ্যাত মুফাসসিরগণ ইকরিমার উল্লেখিত ব্যাখ্যায় প্রদত্ত মত গ্রহণ করেননি। ইমাম তাবারী বিভিন্ন সনদে ইকরিমার উল্লেখিত ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করার পর তার প্রতিবাদ করে বলেছেন যে, ইকরিমার এই মত ভিত্তিহীন। তিনি বলেন যে, সঠিক মত হলো এখানে ‘মোবারক রজনী' বলতে ‘লাইলাতুল কদরকে বুঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ যে রজনীতে কুরআন কারীম অবতীর্ণ করেছেন সেই রাত্রিকে একস্থানে লাইলাতুল কাদর বা ‘মহিমান্বিত রজনী' বলে অবহিত করেছেন (সূরা : ৯৭ ক্বাদর, আয়াত-১)। অন্যত্র এই রাত্রিকেই ‘লাইলাতুম্মুবারাকা' বা ‘বরকতময় রজনী' বলে অভিহিত করেছেন এবং এই রাত্রিটি নিঃসন্দেহে রামাদান মাসের মধ্যে; কারণ অন্যত্র আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, ‘‘তিনি রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন।’’ (সূরা : ১ বাকারা, আয়াত-১৮৫)। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মোবারক রজনী রামাদান মাসে, শা'বান মাসে নয়। (তাবারী, তাফসীর-২৫/১০৭-১০৯)।
পরবর্তী মুফাসসিরগণ ইমাম তাবারীর সাথে ঐকমত্য পোষণ করে বলেছেন যে, ‘লাইলাতুল ক্বাদর' ও ‘লাইলাতুম্মুবারাকা' একই রাতের দুটি উপাধি। দুটি কারণে মুফাসসিরগণ ইকরিমার তাফসীরকে বাতিল বা অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন :
১. ইকরিমার এই মতটি পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট বাণীর সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, কুরআন কারীমে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে যে, একটি মোবারক রাত্রিতে ও একটি মহিমান্বিত রাত্রিতে তিনি কুরআন নাযিল করেছেন। এ সকল আয়াতের সমন্বিত স্পষ্ট অর্থ হলো, আল্লাহ রামাদান মাসের একরাতে কুরআন নাযিল করেছেন এবং সেই রাত্রিটি বরকতময় ও মহিমান্বিত। মোবারক রজনীর ব্যাখ্যায় মধ্য শা'বানের রজনীর উল্লেখ করার অর্থ হলো উল্লেখিত আয়াতগুলোর স্পষ্ট অর্থের ভুল ব্যাখ্যা।
২. বিভিন্ন সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা ‘মোবারক রজনী'র ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এই রাত্রিটি হলো ‘লাইলাতুল ক্বাদর' বা মহিমান্বিত রজনী। সাহাবীগণের মধ্য থেকে ইবন আববাস (রাঃ) ও ইবন উমার (রাঃ) থেকে এ ধরনের ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। তাবেয়ীগণের মধ্য থেকে আবু আবদুর রহমান আল-সুলামী (৭৪ হিঃ), মুজাহিদ বিন জাবর (১০২ হিঃ), হাসান বসরী (১১০ হিঃ) কাতাদা ইবন দি'আমা (১১৭ হিঃ) ও আবদুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম মাদানী (১৮২ হিঃ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা সকলেই ব্যাখ্যা করেছেন যে, ‘লাইলাতুম্মুবারাকাহ অর্থ হলো ‘লাইলাতুল ক্বাদর।' (নাহ্হাস মা'আনিল কুরআন ৬/৩৯৫; যামাখশারী, আল-কাশশাফ ৩/৪২৯; ইবনুল ১আরাবী, আহকামুল কুরআন ৪/১৬৯০; ইবনু আতিয়্যাহ, আল-মুহাররার আল-ওয়াজীয ৫/৬৮-৬৯; কুরতরী, তাফসীর/১৬/১২৬; আবু হাইয়্যান, আল-বাহর আল-মুহীত ৮/৩২-৩৩; ইবন কাছীর, তাফসীর ৪/১৪০; সূয়ূতী, আদ-দুররুল মানছুর ৫/৭৩৮-৭৪২; শাওকানী, ফাতহুল কাদীর ৪/৫৭০-৫৭২; আলুসী, রুহুল মা'আনী ১৩/১১০; থানবী, তাফসীল-ই আশরাফী ৫/৬১৫-৬১৬; সাবুনী মুহাম্মদ আলী, সাফওয়াতুত তাফাসীর ৩/১৭০-১৭১; মুফতী শফী, মা'আরেফ আল-কুরআন ৭/৮৩৫-৮৩৬; ও আবুল ‘আলা, মওদূদী, তাফহীমুল কুরআন ১৪/১৩৯)।
য মধ্য শা'বানের রাত্রে ভাগ্য লিখন : ‘‘কিছু কিছু হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই রাত্রিতে ভাগ্য অনুলিপি করা হয়, পরবর্তী বছরের জন্য হায়াত, মউত ও রিযক ইত্যাদির অনুলিপি করা হয়। উক্ত হাদীসগুলোর সনদ বিস্তারিত নিরীক্ষার পর দেখা যায় যে, এই অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলো অত্যন্ত দুর্বল অথবা বানোয়াট। এই অর্থে কোন সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয়নি।’’ (ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি, পৃ-৪১৪)।
য শবে বরাতে নির্ধারিত রাক'আত ও পদ্ধতির সালাত আদায় সংক্রান্ত ফযীলতের হাদীস : শবে বরাত উপলক্ষে কিছু বর্ণনায় এ রাত্রিতে বিশেষ পদ্ধতিতে বিশেষ সূরা পাঠের মাধ্যমে, নির্দিষ্ট সংখ্যক রাক'আত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযীলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী এই অর্থে বর্ণিত যাবতীয় হাদীস বানোয়াট ও জাল বলে প্রতীয়মান হয়েছে। হিজরী ৪র্থ শতকের পরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে বানিয়ে এগুলো প্রচার করা হয়েছে। এখানে এ জাতীয় কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলো :
১. ৩০০ রাক'আত সংক্রান্ত জাল-হাদীস : বর্ণিত আছে যে, ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শা'বানের রাতে প্রত্যেক রাক'আতে ৩০ বার সূরা ইখলাস পাঠের মাধ্যমে ৩০০ রাক'আত সালাত আদায় করবে, জাহান্নামের আগুন অবধারিত এমন ১০ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’’ হাদীসটি আল্লামা ইবনুর ক্বায়্যিম বাতিল বা ভিত্তিহীন হাদীসসমূহের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। (ইবনুল ক্বাইয়্যিম, নাক্বদুল মানকুল ০১/৮৫)।
২. ১০০ রাক'আত সংক্রান্ত জাল-হাদীস : মধ্য শা'বানের রজনীতে ১০০ রাক'আত সালাত আদায়ের প্রচলন হিজরী ৪র্থ শতকের পরে মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিগণ উল্লেখ করেছেন যে, ৪৪৮ হি. সনে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রথম ইহার প্রচলন শুরু হয়। (মোল্লা'আলী ক্বারী মিরক্বাতুল মাফাতীহ ৩/৩৮৮)। এ সময়ে বিভিন্ন মিথ্যাবাদী-গল্পকার, ওয়ায়েয এই অর্থে কিছু জাল হাদীস তৈরি করে প্রচার করে। এই অর্থে বেশ কিছু জাল হাদীস বর্ণিত হয়েছে যার প্রত্যেকটিই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হওয়ার দলিল বিদ্যমান, তার মধ্য থেকে একটি বর্ণনা এখানে উল্লেখ করছি। এ বিষয়ে হযরত আলী ইবন আবি তালিব (রা.)-এর নামে প্রচারিত; ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শা'বানের রাতে ১০০ রাক'আত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাক'আতে সূরা ফাতিহা ও ১০ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে সে উক্ত রাতে যত প্রয়োজনের কথা বলবে আল্লাহ তা'আলা তার সকল প্রয়োজন পূরণ করবেন। লাওহে মাহফুযে তাকে দুর্ভাগা লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরিবর্তন করে সৌভাগ্যবান হিসেবে তার নিয়তি নির্ধারণ করা হবে। আল্লাহ তা'আলা তার কাছে ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার পাপরাশি মুছে দিবে, বছরের শেষ পর্যন্ত তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন রাখবেন, এছাড়াও আল্লাহ তা'আলা ‘আদন' জান্নাতে ৭০ হাজার বা ৭ লাখ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা বেহেশতের মধ্যে তার জন্য নহর ও প্রাসাদ নির্মাণ করবে এবং তার জন্য বৃক্ষরাজি রোপণ করবে...। যে ব্যক্তি এ নামায আদায় করবে এবং পরকালের শান্তি কামনা করবে আল্লাহ তা'আলা তার জন্য তার অংশ প্রদান করবেন। হাদীসটি সর্বসম্মতভাবে বানোয়াট ও জাল হিসেবে প্রমাণিত। এর বর্ণনাকারীগণ কেউ অজ্ঞাত পরিচয় এবং কেউ মিথ্যাবাদী জালিয়াত হিসেবে পরিচিত। (ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ'আত ০২/৪৯-৫০; সূয়ুতী আল-লাআলী, ০২/৫৭-৫৮; ইবন ইরাক, তানযীহ, ০২/৯২-৯৩; মোল্লা ক্বারী, আল-আসরার, পৃ-৩৩০৩৩১; আল-মাসনু', পৃ-২০৮-২০৯; শাওকানী, আল ফাওয়ায়েদ ০১/৭৫-৭৬)।
৩. ৫০ রাক'আত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম যাহাবী একে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট হাদীস হিসেবে হাদীসটির বর্ণনাকারী অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মদ বিন সাঈদ আলমীলী আত-তাবারীর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন। উক্ত মুহাম্মদ বিন সাঈদ এ হাদীসটি তার মতই অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মদ বিন আমর আল-বাজালী এর সনদে হযরত আনাস রা. থেকে মরফু হিসেবে বর্ণনা করেছেন। (যাহাবী, মীযানুল ই'তিদাল, ০৬/১৬৮-১৬৯)।
৪. মধ্য শা'বানের রজনীতে ১৪ রাক'আত সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসটি উল্লেখ করে ইমাম বায়হাক্বী বলেন, ‘‘ইমাম আহমদ বলেছেন যে, এই হাদীসটি আপত্তিকর, পরিত্যক্ত, জাল ও বানোয়াট বলে প্রমাণিত। কেননা হাদীসটির সনদে অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারীগণ রয়েছে।’’ (বায়হাক্বী, শু'আব আল-ঈমান, ০৩/৩৮৬-৩৮৭, হাদীস নং-৩৮৪১)।
৫. উক্ত রাত্রে ১২ রাক'আত সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসটি জালিয়াতকারীগণ হযরত আবু হুরায়রা রা. পর্যন্ত একটি জাল সনদ তৈরি করে তাঁর সূত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে প্রচার করেছে। উক্ত হাদীসটির সনদের অধিকাংশ বর্ণনাকারীই অজ্ঞাত। পরিচিত বর্ণনাকারীগণ দুর্বল ও পরিত্যাজ্য। (ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ'আত, ০২/৫২; সুয়ূতী, আল-লাআলী ০২/৫৯)।
উপরের আলোচনার মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, মধ্য শা'বানের রাত্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সূরার মাধ্যমে নির্দিষ্ট রাক'আত সালাত আদায় সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসসমূহ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। পরীক্ষা-নিরীক্ষাকারী মুহাদ্দিসগণ এব্যাপারে সকলেই একমত। মোল্লা আলী ক্বারী (১০১৪ হি) মধ্য শা'বানের রাত্রে সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসগুলোর অসারতা উল্লেখপূর্বক বলেন, এ সালাত ৪র্থ হিজরী শতকের পর ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে, যার উৎপত্তি হয়েছে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে। এব্যাপারে অসংখ্য জাল-হাদীস তৈরি করা হয়েছে, যার একটিও সঠিক বা নির্ভরযোগ্য নয়। (মোল্লা ‘আলী ক্বারী, আল-আসরার, পৃ-৩৩০-৩৩১; ইবনুল ক্বাইয়্যেম, আল-মানার আল-মুনীফ, পৃ-৮৯-৯৯)।
য মধ্য শা'বানের রাতে কিয়াম ও দিনে সিয়াম সংক্রান্ত হাদীস : ইমাম ইবন মাজহ তাঁর সুনান গ্রন্থে উল্লেখিত বিষয়ে একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন, ‘‘আলী (রা.) বলেন, যখন মধ্য শা'বানের রাত আসে তখন তোমরা রাতে (সালাতে-দোয়ায়) দন্ডায়মান থাকো এবং দিবসে সিয়াম পালন করো। কারণ ঐদিন সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, ‘কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো। কোনো রিযক অনুসন্ধানকারী আছো কি? আমি তাকে রিযক প্রদান করবো। কোনো দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি আছো কি? আমি তাকে মুক্ত করবো।' এভাবে সুবহে সাদিক উদয় হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে।’’
অত্র হাদীসটি ইমাম ইবন মাজাহ কর্তৃক সংকলিত হওয়ার কারণে হাদীসটি আমাদের সমাজে বহুল পরিচিত, প্রচারিত ও আলোচিত। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে বানোয়াট বলে চিহ্নিত করেছেন। এ হাদীসটি একমাত্র ইবন আবি সাবরাহ ছাড়া অন্যকেউ বর্ণনা করেননি। শুধুমাত্র ইবন আবি সাবরাহ দাবি করেছেন যে, তিনি ইবরাহীম বিন মোহাম্মদ থেকে, হাদীসটি শ্রবণ করেছেন।
ইবন আবি সাবরাহ (১৬২ হি.)-এর পূর্ণ নাম আবু বকর বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন আবি সাবরাহ। তিনি মদীনায় বসবাস করতেন। কিন্তু তুলনামূলক নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে হাদীসের ইমামগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে, তিনি হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিতেন। অসংখ্য ইমাম তাকে মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। তন্মধ্যে, ইমাম বুখারী, ইমাম আহমদ, ইয়াইয়া বিন মাঈন, আলী ইবনুল মাদীনী, ইবনু আদী, ইবন্ হিববান ও হাকিম নাইসাপুরী অন্যতম। (ইবন্ হাজার আস-কালানী, তাকবীর পৃ- ৬২৩; তাহযীব, ১২/২৫-২৬)।
এই আলোকে আল্লামা শিহাবউদ্দিন আহমদ বিন আবি বকর আল-বুসীরী (৮৪০ হি.) অত্র হাদীস এর টিকায় বলেছেন, ইবন্ আবি সাবরাহ এর দুর্বলতার কারণে উক্ত সনদটি দুর্বল। ইমাম আহমদ ও ইবন্ মাঈন তাকে হাদীস বানোয়াটকারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। (আল-বুসীরী, যাওয়ায়েদ ইবন্ মাজাহ পৃ-২০৩)।
শাইখ নাসির উদ্দিন আলবানী, (ইবন্ আবি সাবরাহ) সম্পর্কে বলেছেন যে, তিনি অত্যন্ত দুর্বল ও তার হাদীস বানোয়াট। তিনি আরও বলেছেন যে, অত্র হাদীসটি বানোয়াট। (আলবানী, দাঈফু সুনানি ইবন্ মাজাহ, পৃ-১০৬; যাঈফাহ, ৫/১৫৪)।
য দুই ঈদ ও মধ্য শা'বানের রাতভর ইবাদত : এ সংক্রান্ত একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে : ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শা'বানের রাত ও দুই ঈদের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকবে তার অন্তরের মৃত্যু হবে না। যেদিন সকল অন্তর মরে যাবে।’’
অত্র হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী ‘ঈসা ইবন্ ইবরাহীম ইবন্ তাহমান' বাতিল হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে পরিচিত। ঈমাম বুখারী, নাসায়ী, ইয়াহইয়া বিন মাঈন ও আবু হাতিম রাযি ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস একবাক্যে তাকে পরিত্যক্ত বা মিথ্যাবাদী বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন, এছাড়া ঈসা ইবন্ ইবরাহীম নামক এই ব্যক্তি তার উস্তায হিসেবে যার নাম উল্লেখ করেছেন ‘মারওয়ান বিন সালিম' মিথ্যা হাদীস বর্ণনায় অভিযোগে অভিযুক্ত। (ইবন্ যাওযী, আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়া ০২/৫৬২; ইবন হাজার, আল-ইসাবা ফী তাময়ীযীস সাহাবা ০৫/৫৮০; তালখীস আল-হাবীব, ০২/৬০৬)।
এভাবে আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘‘যে ব্যক্তি পাঁচ রাত (ইবাদতে) জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত অপরিহার্য হবে, ‘‘যিলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখের রাত্রি, ৯ তারিখের (‘আরাফা) রাত্রি, ১০ তারিখের (ঈদুল আযহার) রাত্রি, ঈদুল ফেতরের রাত্রি ও মধ্য শা'বানের রাত্রি।’’ হাদীসটির বর্ণনাকারী আব্দুর রহীম ইবন্ যাইদ আল-‘আম্মী (১৮৪ হিঃ) নামক ব্যক্তি মিথ্যা ও জাল হাদীস বর্ণনাকারী বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, ইয়াহইয়া ইবন্ মাইন, আহমদ ইবন্ হাম্মল, আবু হাতিম রাযী, আবু দাউদ ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস এই ব্যক্তির জালিয়াতির বিষয় উল্লেখ করেছেন। এজন্য অত্র হাদীসটি মাওযূ বা জাল হাদীস বলে গণ্য। ইবনুল জাওযী, ইবন্ হাজার ‘আসকালানী, মুহম্মদ নাসিরউদ্দিন আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। (আল-মুনযিরী, আত-তারগীব ০২/৯৬; যাহাবী, মীযানুল ই'তিদাল ০৪/৩৩৬; আলবানী, যায়ীফাহ ০২/১২)।
য শবে বরাতের গোসল : শবে বরাত বিষয়ক প্রচলিত কথাগুলোর অন্যতম হলো ‘এই রাত্রে গোসল করার ফযীলত।' বিষয়টি যদিও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবুও আমাদের সমাজে তা বহুল প্রচলিত। আমাদের দেশের প্রচলিত অনেক পুস্তকেই এই জাল হাদীসটি লেখা হয় এবং ওয়াযে আলোচনা করা হয়। ‘মাওলানা গোলাম রহমান' রচিত মকছুদোল মো'মেনীন, পৃ-২৪০; মুফতী হাবীব ছামদানী রচিত বার চান্দের ফযীলত, পৃ-২৬; অধ্যাপিকা কামরুনেসা দুলাল রচিত পুস্তক পৃ- ২৪০; মুফতী হাবীব ছামদানী রচিত বার চান্দের ফযীলত, পৃ-২৬; অধ্যাপিকা কামরুন্নেসা দুলাল রচিত পুস্তক পৃ-৩০৯-এর অত্র হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘‘একটি হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি উক্ত রাত্রিতে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় গোসল করবে, সেই ব্যক্তির গোসলের প্রত্যেকটি বিন্দু পানির পরিবর্তে তাহার আমলনামায় ৭০০ রাকাত নামাযের ছওয়াব লিখা যাইবে। গোসল করিয়া দুই রাকাত তাইয়্যাতুল অজুর নামায পড়িবে।...’
সূত্র এখানে
এমনি এক দুশমন ছিল আবদুল্লাহ ইবনু সাবা-ইয়ামানের ইহুদী। হযরত উসমানের (রাঃ) খেলাফতকালে সে মুসলমান নাম ধারণ করে ইসলামের ক্ষতি করার জন্য বিভিন্ন শহরে ও জনপদে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক কথা প্রচার করতে থাকে। হিজাজ, বসরা, কুফা ও সিরিয়ায় তেমন সুবিধা করতে না পেরে সে মিসর গিয়ে জাল হাদিস তৈরি করে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকে। অন্যদিকে হিঃ ৪র্থ-৫ম শতাব্দীতে একদল মানুষ যারা নেককার ও দরবেশ বলে পরিচিতি লাভ করে। তারা তাদের অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তির কারণে (সওয়াবের আশায়?) বানোয়াট কথা হাদিসের নামে সমাজে প্রচার করতেন। এদের বাহ্যিক পরহেযগারী, নির্লোভ জীবন যাপন পদ্ধতি দেখে মানুষ সরল মনে এদের কথা বিশ্বাস করে এ সকল বানোয়াট কথা হাদিস বলে গ্রহণ করতো। পরবর্তী সময়ে হাদিসের অভিজ্ঞ ইমামগণ সূক্ষ্ম নিরীক্ষার মাধ্যমে এদের মিথ্যাচার ও জালিয়াতি ধরে ফেলেন এবং তা প্রকাশ করে গ্রন্থ রচনা করেন। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা এ বিষয়ে ‘‘শবে বরাতে’’ সংক্রান্ত প্রকৃত অবস্থা ও এর সঠিক মর্যাদা, পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে আলোচনা করবো। সাথে সাথে সমাজে প্রচলিত বিভ্রান্তির কারণস্বরূপ এ সংক্রান্ত জাল হাদিসগুলোও কিছু আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ।
প্রথমত: ‘শা'বানের মধ্যম রজনী'র বিশেষ ফযিলত : মধ্য শা'বানের রজনীতে সৃষ্টি জীবের প্রতি বিশেষভাবে আল্লাহর ক্ষমা প্রদানের বিষয়টি সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এ সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘‘ইন্নাল্লাহা লাইত্তালিউ ফিলাইলাতিন নিছফিমিন শা'বানা ফাইয়াগফিরু লিজামিয়ি খলক্বিহি ইল্লালি মুশরিকন আও মুশাহিনিন।’’ - ‘‘আল্লাহতায়ালা মধ্য শা'বানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং ‘শির্ককারী' ও বিদ্বেষ-হিংসা পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’’ এই অর্থের হাদিস কাছাকাছি শব্দে ৮ জন সাহাবী আবু বকর সিদ্দিক, আয়েশা, আবু হুরায়রা, আবু মূসা আশ'আরী, মুয়ায ইবন জাবাল, আবদুল্লাহ ইবন আমর, আউফ ইবন মালিক ও আবু সা'লাবা আল-খুশানী (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে বর্ণিত হয়েছে। (ইবন মাযাহ, আস-সুনান ১/৪৪৫, বায্যার, আল-মুসনাদ ১/১৫৭, ২০৭, ৭/১৮৬; আহমদ ইবন হাম্বল, আল-মুসনাদ ২/১৭৬; ইবন আবি আসিম, আস-সুন্নাহ, পৃঃ ২২৩-২২৪; ইবন হিববান, আস-সহীহ ১২/৪৮১; তাবরানী, আল-মু'জাম আল-কাবীর ২০/১০৮, ২২/২২৩; আল-মু'জাম আল-আওসাত, ৭/৬৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, ৩/৩৮১; ইবন খুযায়মা, কিতাবুত তাওহীদ ১/৩২৫-৩২৬)। এ সকল হাদিসের মধ্যে কিছু সনদ দুর্বল ও কিছু সনদ ‘হাসান' পর্যায়ের। সামগ্রিক বিচারে হাদিসটি সহীহ। আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দিন আলবানী (রহঃ) বলেন, হাদিসটি সহীহ যে মূল কথা অনেক সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা পরস্পর একে অপরকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে।... (আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীস আস-সাহীহাহ ৩/১৩৫)।
অত্র হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, শা'বান মাসের মধ্যম রজনীটি একটি ফযিলতপূর্ণ বরকতময় মাগফেরাতের রাত্রি। এই রাতে আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদেরকে (যারা-মুশরিক নন, অংশীবাদী নন, জীবনে সকল ধরনের শির্কমুক্ত এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত জীবনযাপন করেন) ক্ষমা করে দেন। কিন্তু এই ক্ষমা অর্জনের জন্য শির্ক ও বিদ্বেষ বর্জন ব্যতীত অন্য কোন ইবাদত-বন্দেগীর প্রয়োজন আছে কিনা তা অত্র হাদিসে উল্লেখ করা হয়নি।
দ্বিতীয়ত ঃ ‘‘লাইলাতুম্মুবারাকাহ’’ আয়াতের তাফসীর : পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, ‘‘ইন্না আনযালনাহু ফিলাইলাতিম মুবারাকাতিন, ইন্না কুন্না মুনযিরিন।’’ (সূরা : ৪৪ দুখান, আয়াত-৩)। ‘‘আমি তো তা (আল-কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এক মোবারক রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী।’’
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় শুধুমাত্র তাবিয়ী ‘ইকরিমাহ' বলেন, এখানে ‘মোবারক রজনী' বলতে ‘মধ্য শা'বানের রাত্রিকে বুঝানো হয়েছে। ইকরিমাহ আরও বলেন, অত্র রাতে গোটা বছরের সকল বিষয়ে ফায়সালা করা হয়। (তাবারী, তাফসীর ২৫/১০৭-১০৯)।
কিন্তু প্রখ্যাত মুফাসসিরগণ ইকরিমার উল্লেখিত ব্যাখ্যায় প্রদত্ত মত গ্রহণ করেননি। ইমাম তাবারী বিভিন্ন সনদে ইকরিমার উল্লেখিত ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করার পর তার প্রতিবাদ করে বলেছেন যে, ইকরিমার এই মত ভিত্তিহীন। তিনি বলেন যে, সঠিক মত হলো এখানে ‘মোবারক রজনী' বলতে ‘লাইলাতুল কদরকে বুঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ যে রজনীতে কুরআন কারীম অবতীর্ণ করেছেন সেই রাত্রিকে একস্থানে লাইলাতুল কাদর বা ‘মহিমান্বিত রজনী' বলে অবহিত করেছেন (সূরা : ৯৭ ক্বাদর, আয়াত-১)। অন্যত্র এই রাত্রিকেই ‘লাইলাতুম্মুবারাকা' বা ‘বরকতময় রজনী' বলে অভিহিত করেছেন এবং এই রাত্রিটি নিঃসন্দেহে রামাদান মাসের মধ্যে; কারণ অন্যত্র আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, ‘‘তিনি রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন।’’ (সূরা : ১ বাকারা, আয়াত-১৮৫)। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মোবারক রজনী রামাদান মাসে, শা'বান মাসে নয়। (তাবারী, তাফসীর-২৫/১০৭-১০৯)।
পরবর্তী মুফাসসিরগণ ইমাম তাবারীর সাথে ঐকমত্য পোষণ করে বলেছেন যে, ‘লাইলাতুল ক্বাদর' ও ‘লাইলাতুম্মুবারাকা' একই রাতের দুটি উপাধি। দুটি কারণে মুফাসসিরগণ ইকরিমার তাফসীরকে বাতিল বা অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন :
১. ইকরিমার এই মতটি পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট বাণীর সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, কুরআন কারীমে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে যে, একটি মোবারক রাত্রিতে ও একটি মহিমান্বিত রাত্রিতে তিনি কুরআন নাযিল করেছেন। এ সকল আয়াতের সমন্বিত স্পষ্ট অর্থ হলো, আল্লাহ রামাদান মাসের একরাতে কুরআন নাযিল করেছেন এবং সেই রাত্রিটি বরকতময় ও মহিমান্বিত। মোবারক রজনীর ব্যাখ্যায় মধ্য শা'বানের রজনীর উল্লেখ করার অর্থ হলো উল্লেখিত আয়াতগুলোর স্পষ্ট অর্থের ভুল ব্যাখ্যা।
২. বিভিন্ন সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা ‘মোবারক রজনী'র ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এই রাত্রিটি হলো ‘লাইলাতুল ক্বাদর' বা মহিমান্বিত রজনী। সাহাবীগণের মধ্য থেকে ইবন আববাস (রাঃ) ও ইবন উমার (রাঃ) থেকে এ ধরনের ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। তাবেয়ীগণের মধ্য থেকে আবু আবদুর রহমান আল-সুলামী (৭৪ হিঃ), মুজাহিদ বিন জাবর (১০২ হিঃ), হাসান বসরী (১১০ হিঃ) কাতাদা ইবন দি'আমা (১১৭ হিঃ) ও আবদুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম মাদানী (১৮২ হিঃ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা সকলেই ব্যাখ্যা করেছেন যে, ‘লাইলাতুম্মুবারাকাহ অর্থ হলো ‘লাইলাতুল ক্বাদর।' (নাহ্হাস মা'আনিল কুরআন ৬/৩৯৫; যামাখশারী, আল-কাশশাফ ৩/৪২৯; ইবনুল ১আরাবী, আহকামুল কুরআন ৪/১৬৯০; ইবনু আতিয়্যাহ, আল-মুহাররার আল-ওয়াজীয ৫/৬৮-৬৯; কুরতরী, তাফসীর/১৬/১২৬; আবু হাইয়্যান, আল-বাহর আল-মুহীত ৮/৩২-৩৩; ইবন কাছীর, তাফসীর ৪/১৪০; সূয়ূতী, আদ-দুররুল মানছুর ৫/৭৩৮-৭৪২; শাওকানী, ফাতহুল কাদীর ৪/৫৭০-৫৭২; আলুসী, রুহুল মা'আনী ১৩/১১০; থানবী, তাফসীল-ই আশরাফী ৫/৬১৫-৬১৬; সাবুনী মুহাম্মদ আলী, সাফওয়াতুত তাফাসীর ৩/১৭০-১৭১; মুফতী শফী, মা'আরেফ আল-কুরআন ৭/৮৩৫-৮৩৬; ও আবুল ‘আলা, মওদূদী, তাফহীমুল কুরআন ১৪/১৩৯)।
য মধ্য শা'বানের রাত্রে ভাগ্য লিখন : ‘‘কিছু কিছু হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই রাত্রিতে ভাগ্য অনুলিপি করা হয়, পরবর্তী বছরের জন্য হায়াত, মউত ও রিযক ইত্যাদির অনুলিপি করা হয়। উক্ত হাদীসগুলোর সনদ বিস্তারিত নিরীক্ষার পর দেখা যায় যে, এই অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলো অত্যন্ত দুর্বল অথবা বানোয়াট। এই অর্থে কোন সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয়নি।’’ (ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি, পৃ-৪১৪)।
য শবে বরাতে নির্ধারিত রাক'আত ও পদ্ধতির সালাত আদায় সংক্রান্ত ফযীলতের হাদীস : শবে বরাত উপলক্ষে কিছু বর্ণনায় এ রাত্রিতে বিশেষ পদ্ধতিতে বিশেষ সূরা পাঠের মাধ্যমে, নির্দিষ্ট সংখ্যক রাক'আত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযীলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী এই অর্থে বর্ণিত যাবতীয় হাদীস বানোয়াট ও জাল বলে প্রতীয়মান হয়েছে। হিজরী ৪র্থ শতকের পরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে বানিয়ে এগুলো প্রচার করা হয়েছে। এখানে এ জাতীয় কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলো :
১. ৩০০ রাক'আত সংক্রান্ত জাল-হাদীস : বর্ণিত আছে যে, ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শা'বানের রাতে প্রত্যেক রাক'আতে ৩০ বার সূরা ইখলাস পাঠের মাধ্যমে ৩০০ রাক'আত সালাত আদায় করবে, জাহান্নামের আগুন অবধারিত এমন ১০ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’’ হাদীসটি আল্লামা ইবনুর ক্বায়্যিম বাতিল বা ভিত্তিহীন হাদীসসমূহের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। (ইবনুল ক্বাইয়্যিম, নাক্বদুল মানকুল ০১/৮৫)।
২. ১০০ রাক'আত সংক্রান্ত জাল-হাদীস : মধ্য শা'বানের রজনীতে ১০০ রাক'আত সালাত আদায়ের প্রচলন হিজরী ৪র্থ শতকের পরে মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিগণ উল্লেখ করেছেন যে, ৪৪৮ হি. সনে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রথম ইহার প্রচলন শুরু হয়। (মোল্লা'আলী ক্বারী মিরক্বাতুল মাফাতীহ ৩/৩৮৮)। এ সময়ে বিভিন্ন মিথ্যাবাদী-গল্পকার, ওয়ায়েয এই অর্থে কিছু জাল হাদীস তৈরি করে প্রচার করে। এই অর্থে বেশ কিছু জাল হাদীস বর্ণিত হয়েছে যার প্রত্যেকটিই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হওয়ার দলিল বিদ্যমান, তার মধ্য থেকে একটি বর্ণনা এখানে উল্লেখ করছি। এ বিষয়ে হযরত আলী ইবন আবি তালিব (রা.)-এর নামে প্রচারিত; ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শা'বানের রাতে ১০০ রাক'আত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাক'আতে সূরা ফাতিহা ও ১০ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে সে উক্ত রাতে যত প্রয়োজনের কথা বলবে আল্লাহ তা'আলা তার সকল প্রয়োজন পূরণ করবেন। লাওহে মাহফুযে তাকে দুর্ভাগা লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরিবর্তন করে সৌভাগ্যবান হিসেবে তার নিয়তি নির্ধারণ করা হবে। আল্লাহ তা'আলা তার কাছে ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার পাপরাশি মুছে দিবে, বছরের শেষ পর্যন্ত তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন রাখবেন, এছাড়াও আল্লাহ তা'আলা ‘আদন' জান্নাতে ৭০ হাজার বা ৭ লাখ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা বেহেশতের মধ্যে তার জন্য নহর ও প্রাসাদ নির্মাণ করবে এবং তার জন্য বৃক্ষরাজি রোপণ করবে...। যে ব্যক্তি এ নামায আদায় করবে এবং পরকালের শান্তি কামনা করবে আল্লাহ তা'আলা তার জন্য তার অংশ প্রদান করবেন। হাদীসটি সর্বসম্মতভাবে বানোয়াট ও জাল হিসেবে প্রমাণিত। এর বর্ণনাকারীগণ কেউ অজ্ঞাত পরিচয় এবং কেউ মিথ্যাবাদী জালিয়াত হিসেবে পরিচিত। (ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ'আত ০২/৪৯-৫০; সূয়ুতী আল-লাআলী, ০২/৫৭-৫৮; ইবন ইরাক, তানযীহ, ০২/৯২-৯৩; মোল্লা ক্বারী, আল-আসরার, পৃ-৩৩০৩৩১; আল-মাসনু', পৃ-২০৮-২০৯; শাওকানী, আল ফাওয়ায়েদ ০১/৭৫-৭৬)।
৩. ৫০ রাক'আত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম যাহাবী একে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট হাদীস হিসেবে হাদীসটির বর্ণনাকারী অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মদ বিন সাঈদ আলমীলী আত-তাবারীর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন। উক্ত মুহাম্মদ বিন সাঈদ এ হাদীসটি তার মতই অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মদ বিন আমর আল-বাজালী এর সনদে হযরত আনাস রা. থেকে মরফু হিসেবে বর্ণনা করেছেন। (যাহাবী, মীযানুল ই'তিদাল, ০৬/১৬৮-১৬৯)।
৪. মধ্য শা'বানের রজনীতে ১৪ রাক'আত সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসটি উল্লেখ করে ইমাম বায়হাক্বী বলেন, ‘‘ইমাম আহমদ বলেছেন যে, এই হাদীসটি আপত্তিকর, পরিত্যক্ত, জাল ও বানোয়াট বলে প্রমাণিত। কেননা হাদীসটির সনদে অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারীগণ রয়েছে।’’ (বায়হাক্বী, শু'আব আল-ঈমান, ০৩/৩৮৬-৩৮৭, হাদীস নং-৩৮৪১)।
৫. উক্ত রাত্রে ১২ রাক'আত সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসটি জালিয়াতকারীগণ হযরত আবু হুরায়রা রা. পর্যন্ত একটি জাল সনদ তৈরি করে তাঁর সূত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে প্রচার করেছে। উক্ত হাদীসটির সনদের অধিকাংশ বর্ণনাকারীই অজ্ঞাত। পরিচিত বর্ণনাকারীগণ দুর্বল ও পরিত্যাজ্য। (ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ'আত, ০২/৫২; সুয়ূতী, আল-লাআলী ০২/৫৯)।
উপরের আলোচনার মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, মধ্য শা'বানের রাত্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সূরার মাধ্যমে নির্দিষ্ট রাক'আত সালাত আদায় সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসসমূহ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। পরীক্ষা-নিরীক্ষাকারী মুহাদ্দিসগণ এব্যাপারে সকলেই একমত। মোল্লা আলী ক্বারী (১০১৪ হি) মধ্য শা'বানের রাত্রে সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসগুলোর অসারতা উল্লেখপূর্বক বলেন, এ সালাত ৪র্থ হিজরী শতকের পর ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে, যার উৎপত্তি হয়েছে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে। এব্যাপারে অসংখ্য জাল-হাদীস তৈরি করা হয়েছে, যার একটিও সঠিক বা নির্ভরযোগ্য নয়। (মোল্লা ‘আলী ক্বারী, আল-আসরার, পৃ-৩৩০-৩৩১; ইবনুল ক্বাইয়্যেম, আল-মানার আল-মুনীফ, পৃ-৮৯-৯৯)।
য মধ্য শা'বানের রাতে কিয়াম ও দিনে সিয়াম সংক্রান্ত হাদীস : ইমাম ইবন মাজহ তাঁর সুনান গ্রন্থে উল্লেখিত বিষয়ে একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন, ‘‘আলী (রা.) বলেন, যখন মধ্য শা'বানের রাত আসে তখন তোমরা রাতে (সালাতে-দোয়ায়) দন্ডায়মান থাকো এবং দিবসে সিয়াম পালন করো। কারণ ঐদিন সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, ‘কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো। কোনো রিযক অনুসন্ধানকারী আছো কি? আমি তাকে রিযক প্রদান করবো। কোনো দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি আছো কি? আমি তাকে মুক্ত করবো।' এভাবে সুবহে সাদিক উদয় হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে।’’
অত্র হাদীসটি ইমাম ইবন মাজাহ কর্তৃক সংকলিত হওয়ার কারণে হাদীসটি আমাদের সমাজে বহুল পরিচিত, প্রচারিত ও আলোচিত। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে বানোয়াট বলে চিহ্নিত করেছেন। এ হাদীসটি একমাত্র ইবন আবি সাবরাহ ছাড়া অন্যকেউ বর্ণনা করেননি। শুধুমাত্র ইবন আবি সাবরাহ দাবি করেছেন যে, তিনি ইবরাহীম বিন মোহাম্মদ থেকে, হাদীসটি শ্রবণ করেছেন।
ইবন আবি সাবরাহ (১৬২ হি.)-এর পূর্ণ নাম আবু বকর বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন আবি সাবরাহ। তিনি মদীনায় বসবাস করতেন। কিন্তু তুলনামূলক নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে হাদীসের ইমামগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে, তিনি হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিতেন। অসংখ্য ইমাম তাকে মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। তন্মধ্যে, ইমাম বুখারী, ইমাম আহমদ, ইয়াইয়া বিন মাঈন, আলী ইবনুল মাদীনী, ইবনু আদী, ইবন্ হিববান ও হাকিম নাইসাপুরী অন্যতম। (ইবন্ হাজার আস-কালানী, তাকবীর পৃ- ৬২৩; তাহযীব, ১২/২৫-২৬)।
এই আলোকে আল্লামা শিহাবউদ্দিন আহমদ বিন আবি বকর আল-বুসীরী (৮৪০ হি.) অত্র হাদীস এর টিকায় বলেছেন, ইবন্ আবি সাবরাহ এর দুর্বলতার কারণে উক্ত সনদটি দুর্বল। ইমাম আহমদ ও ইবন্ মাঈন তাকে হাদীস বানোয়াটকারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। (আল-বুসীরী, যাওয়ায়েদ ইবন্ মাজাহ পৃ-২০৩)।
শাইখ নাসির উদ্দিন আলবানী, (ইবন্ আবি সাবরাহ) সম্পর্কে বলেছেন যে, তিনি অত্যন্ত দুর্বল ও তার হাদীস বানোয়াট। তিনি আরও বলেছেন যে, অত্র হাদীসটি বানোয়াট। (আলবানী, দাঈফু সুনানি ইবন্ মাজাহ, পৃ-১০৬; যাঈফাহ, ৫/১৫৪)।
য দুই ঈদ ও মধ্য শা'বানের রাতভর ইবাদত : এ সংক্রান্ত একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে : ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শা'বানের রাত ও দুই ঈদের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকবে তার অন্তরের মৃত্যু হবে না। যেদিন সকল অন্তর মরে যাবে।’’
অত্র হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী ‘ঈসা ইবন্ ইবরাহীম ইবন্ তাহমান' বাতিল হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে পরিচিত। ঈমাম বুখারী, নাসায়ী, ইয়াহইয়া বিন মাঈন ও আবু হাতিম রাযি ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস একবাক্যে তাকে পরিত্যক্ত বা মিথ্যাবাদী বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন, এছাড়া ঈসা ইবন্ ইবরাহীম নামক এই ব্যক্তি তার উস্তায হিসেবে যার নাম উল্লেখ করেছেন ‘মারওয়ান বিন সালিম' মিথ্যা হাদীস বর্ণনায় অভিযোগে অভিযুক্ত। (ইবন্ যাওযী, আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়া ০২/৫৬২; ইবন হাজার, আল-ইসাবা ফী তাময়ীযীস সাহাবা ০৫/৫৮০; তালখীস আল-হাবীব, ০২/৬০৬)।
এভাবে আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘‘যে ব্যক্তি পাঁচ রাত (ইবাদতে) জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত অপরিহার্য হবে, ‘‘যিলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখের রাত্রি, ৯ তারিখের (‘আরাফা) রাত্রি, ১০ তারিখের (ঈদুল আযহার) রাত্রি, ঈদুল ফেতরের রাত্রি ও মধ্য শা'বানের রাত্রি।’’ হাদীসটির বর্ণনাকারী আব্দুর রহীম ইবন্ যাইদ আল-‘আম্মী (১৮৪ হিঃ) নামক ব্যক্তি মিথ্যা ও জাল হাদীস বর্ণনাকারী বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, ইয়াহইয়া ইবন্ মাইন, আহমদ ইবন্ হাম্মল, আবু হাতিম রাযী, আবু দাউদ ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস এই ব্যক্তির জালিয়াতির বিষয় উল্লেখ করেছেন। এজন্য অত্র হাদীসটি মাওযূ বা জাল হাদীস বলে গণ্য। ইবনুল জাওযী, ইবন্ হাজার ‘আসকালানী, মুহম্মদ নাসিরউদ্দিন আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। (আল-মুনযিরী, আত-তারগীব ০২/৯৬; যাহাবী, মীযানুল ই'তিদাল ০৪/৩৩৬; আলবানী, যায়ীফাহ ০২/১২)।
য শবে বরাতের গোসল : শবে বরাত বিষয়ক প্রচলিত কথাগুলোর অন্যতম হলো ‘এই রাত্রে গোসল করার ফযীলত।' বিষয়টি যদিও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবুও আমাদের সমাজে তা বহুল প্রচলিত। আমাদের দেশের প্রচলিত অনেক পুস্তকেই এই জাল হাদীসটি লেখা হয় এবং ওয়াযে আলোচনা করা হয়। ‘মাওলানা গোলাম রহমান' রচিত মকছুদোল মো'মেনীন, পৃ-২৪০; মুফতী হাবীব ছামদানী রচিত বার চান্দের ফযীলত, পৃ-২৬; অধ্যাপিকা কামরুনেসা দুলাল রচিত পুস্তক পৃ- ২৪০; মুফতী হাবীব ছামদানী রচিত বার চান্দের ফযীলত, পৃ-২৬; অধ্যাপিকা কামরুন্নেসা দুলাল রচিত পুস্তক পৃ-৩০৯-এর অত্র হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘‘একটি হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি উক্ত রাত্রিতে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় গোসল করবে, সেই ব্যক্তির গোসলের প্রত্যেকটি বিন্দু পানির পরিবর্তে তাহার আমলনামায় ৭০০ রাকাত নামাযের ছওয়াব লিখা যাইবে। গোসল করিয়া দুই রাকাত তাইয়্যাতুল অজুর নামায পড়িবে।...’
No comments:
Post a Comment