Thursday, September 15, 2011

লাইলাতুল ক্বদরের গুরুত্ব ও ফজিলত

লাইলাতুল ক্বদরের গুরুত্ব ও ফজিলত

মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানীশিক্ষকঃ জামিয়া উম্মুল ক্কোরা মদিনা মোনাওয়রা , সৌদি আরব

: লাইলাতুল ক্বদর অর্থ মর্যাদার রাত্রি । লাইতুল ক্বদর কখন হতে পারে? লাইলাতুল ক্বদর রমজানে হয় এবং রমজানের শেষ দশকে হয়। শেষ দশকের ব্যাখ্যায় আর একটু বিশ্লেষণ করে মহানবী (স:) বলেন: তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে তা খুঁজে বেড়াও । বিজোড় রাতেরও ব্যাখ্যায় মহানবী (স:) বলেন: লাইলাতুল ক্বদর রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে-একুশে রাত, কিংবা তেইশে রাত অথবা পঁচিশে রাত নতুবা সাতাশে রাত কিংবা উনত্রিশে রাত, যে ব্যক্তি ঐ রাত ইবাদাতে কাটাবে তার আগেকার সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।
মহানবী (স:) এ রাতটিকে খোঁজার জন্যই একবার একমাস ইতিকাফ করেছিলেন। যেমন বিখ্যাত সাহাবী আবূ সাইদ খুদরী (রা:) বলেন, একদা রাসুলুলস্নাহ (স:) রমজানের প্রথম দশকে ইতিকাফ করেন। তারপর তিনি দ্বিতীয় দশকেও ইতিকাফ করেন। তারপর তাঁবু থেকে মুখটা বের করে বলেন আমি লাইলাতুল ক্বদর খোঁজার জন্যই রমজানে প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে ইতিকাফ করলাম। তারপর আমাকে বলা হলো যে, ঐ রাত শেষ দশকে আছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আরো ইতিকাফ করতে পছন্দ করে সে যেনো আবার ইতিকাফ করে। ফলে সাহাবীরা তাঁর সাথে আবার ইতিকাফ করলেন। এ হাদীস দ্বারা একটা প্রশ্ন ওঠে যে, লাইলাতুল ক্বদরের এমন কী মাহাত্ম্য আছে, যার জন্য প্রিয় নবী (স:) ও তাঁর সাহাবীগণ সুদীর্ঘ একটি মাস নিজেদেরকে আলস্নাহর কয়েদী বানিয়ে সারা দুনিয়াকে ভুলে গিয়ে ঐ রাতে খোঁজে ডুবে থাকলেন? বিখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন আলস্নামা ইবনে আবী হাতেম (রহ.) বলেন, একবার রাসুলুলস্নাহ (স:) বাণী ইসরাইলের চারজন সাধকের কথা বললেন, তাঁরা সুদীর্ঘ আশি বছর ধরে এমনভাবে আল্লাহর ইবাদাত করেছেন যে, ঐ সময় চোখের পলক মারার মত সময়ও তাঁরা আল্লাহর না-ফরমানী করেনি। তাঁরা হলেন আইয়ুব, যাকারিয়া, হিযকীল ইবনে আঁজুয ও ইউশা ইবনে নূন। কথাগুলো শুনে সাহাবায়ে কেরাম খুবই আশ্চার্যান্বিত হলেন। ফলে নবী (স:)-এর নিকট জিব্রাইল (আ:) এলেন এবং বললেন, আপনার উম্মত ঐ সাধকের আশি বছরের ইবাদতের কথা শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হচ্ছে? তাই আলস্নাহ তায়ালা এর চেয়েও ভালো জিনিস আপনাদের জন্য নাযিল করেছেন। তা হলো সূরা ক্বদর। যাতে বলা হয়েছে যে, লাইলাতুল ক্বদরে মাত্র একটি রাতের ইবাদত এক হাজার অর্থাৎ তিরাশি বছর চার মাসের ইবাদাতের চেয়েও উত্তম। এ সুসংবাদ শুনে রাসূলুলস্নাহ (স:) ও সহাবাযে কেরাম খুব খুশী হন।, অন্য বর্ণনায় আছে, একদা নবী (স:) কে স্বপ্নে পূর্বেকার লোকেদের আয়ু দেখানো হলো। তখন তিনি বুঝলেন যে, তাঁর উম্মতের আয়ু খুবই কম। সুতরাং তারা সারা জীবন কাজ করলেও ওদের আমলের নিকটেও পৌঁছতে পারবে না। তখন আলস্নাহ তায়ালা তাঁকে লাইলাতুল ক্বদর দান করেন যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
সূরা দুখানের ৪র্থ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: কুরআন নাজিলের বরকতময় রাতে প্রত্যেক গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধানৱ নেয়া হয়। এর ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত আছে যে, এ বছর থেকে আগামী বছর পর্যন্ত বৃষ্টি ও রুজী এবং আয়ু ও মৃত্যুর পরিমাণ যতটা হবে তা এই লাইলাতুল ক্বদরের রাতে নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ পঞ্চাশ হাজার বছর আগে লওহে মাহফুজে যে ভাগ্যলিপি লেখা আছে তা থেকে উক্ত বিষয়গুলো এ রাতে ফেরেশতাদের লিপিবদ্ধ করিয়ে দেয়া হয়। সে জন্য এ রাতকে লাইলাতুল ক্বদর বা ভাগ্য নির্ধারণের রাত বলা হয়। যেসব ফেরেশতাদেরকে উক্ত বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব দেয়া হয় ইবনে আব্বাস (রা:)-এর উক্তি মোতাবেক তাঁরা হলেন চারজন ইসরাফীল, মীকাঈল, জিব্রাইল ও আজরাইল আ
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, একদা রমজানে আমাকে স্বপ্নে বলা হল যে, আজকের রাত ক্বদরের রাত। তখন আমি তন্দ্রালু অবস্থায় দাঁড়ালাম। অত:পর রাসুলুলস্নাহ (স:) এর তাঁবুর সাথে সেঁটে গেলাম। তারপর আমি নবী (স:) এর নিকটে এলাম। তখন তিনি নামাজ পড়ছিলেন। এরপর আমি ঐ রাতটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম যে, ওটা ছিল তেইশের রাত।
কুরআন ও হাদীস ঘাঁটলে বা বিশেস্নষণ করলে এ রাতের যেসব বিশেষ গুণ ও চিহ্ন পাওয়া যায় তা হল এই এ রাতে কুরআন অবতীর্ণের সূচনা হয়। (সূরা ক্বদর: ১, সূরা দুখান:৩ আয়াত)
আমি এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে, আমি তো সতর্ককারী। (সূরা দুখান ৪৪:৩ আয়াত )এ রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিশেষ নির্দেশে অগণিত ফেরেশতা ও রূহুল আমীন জিব্রাইল (আ:) অবতরণ করেন এবং ফজর উদয় হওয়া পর্যনৱ এ রাতের প্রত্যেক বিষয় শানিৱময় হয়।” সূরা ক্বদর: ৪-৫ আয়াত)
সারা জমিনের কাঁকর কুচি যত তার চেয়েও বেশি ফেরেশতা এই রাতে অবতরণ করে। (ইবনে খুযায়মা ৩য় খণ্ড ৩৩২ পৃ: ফতহুল বারী ৪র্থ খণ্ড-২৬০ পৃ:)
উম্মুল মুমেনীন আয়শা (রা:) বলেন, রাসুলুলস্নাহ (স:) রমজানের শেষ দশকে এত সাধ্য-সাধনা করতেন যে, অন্য সময়ে তা করতেন না। (মুসলিম ১ম খণ্ড-৩৭২ পৃ: তিরমিযী ১ম খণ্ড ৯৮ পৃ: ইবনে মাজাহ ১২৭ পৃ: মিশকাত ১৮২ পৃ:)
তিনি কেবল একা নন, বরং পরিবারবর্গকেও ঐ ইবাদাতে শামিল করতেন। যেমন আয়শা (রা:) বলেন, যখন রমজানের শেষ দশক আসতো তখন তিনি নিজে রাত জাগতেন এবং পরিবারবর্গকেও জাগাতেন ও কোমর কষে বাঁধতেন। (বুখারী ২৭১ পৃঃ, মুসলিম ১ খণ্ড-৩৭২) আলী (রা.)-বলেন, ঐ সময় নবী (স.) তাঁর স্ত্রীদের নিকট থেকেও আলাদা থাকতেন। (বায়হাকী ৪র্থ খণ্ড-৩১৪) এবং বিছানাপত্র গুটিয়ে রাখতেন আর এভাবে কাকভোর করে দিতেন। অর্থাৎ এশা থেকে সাহারী পর্যন্ত ইবাদাত করতেন (আবূ ইয়ালা মাজমাউয যাওয়া-য়িদ ৩য় খণ্ড-১৪৪ পৃঃ)
যয়নাব বিনতে উম্মে সালমা (রা.) বলেন, রমজানের যখন দশদিন বাকি থাকতো তখন নবী (স.)-এর পরিবারের যে কেউ সালাতে দাঁড়াতে সৰম হতো তাকে তিনি সালাতে না দাঁড় করিয়ে ছাড়তেন না। (তিরমিযী, ফতহুল বারী ৪র্থ খণ্ড-২৬৯ পৃঃ) মহানবী (স.) রমজানের শেষ দশকে সারা বছরের তুলনায় অনেক বেশি ইবাদাত করতেন এবং প্রায় রাতভর নিজে ইবাদাতের মধ্যে কাটাতেন ও পরিবারবর্গকেও নামাজে দাঁড় করাতেন। বায়হাকীর বর্ণনা দ্বারা জানা যায় যে, দাঁড়িয়ে ও বসে জিকিররত মুমিন বান্দাকে এ রাতে জিব্রাইল (আ.) সালাম দেন এবং ফেরেশতারা মুমিনদের জন্য ৰমা প্রার্থনা করেন। সুতরাং লাইলাতুল ক্বদরের রাতগুলো নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত ও আল্লাহর বিভিন্ন জিকিরের মাধ্যমে কাটানো উচিত। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একদা আমি বললাম, হে আল্লাহর রসুল (সা.) আমি যদি জানতে পারি যে, কোন্‌ রাতটা ক্বদরের তাহলে ঐ রাতে আমি কী বলব? তিনি বললেন, এ দুআ বলবেঃ আলস্না-হুম্মা ইন্নাকা আফূওউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফূ আন্নী।
হে আলস্নাহ! তুমি ৰমাময়। তুমি ৰমা করা ভালোবাসো। অতএব, আমাকে ৰমা করো। অন্য বর্ণনায় মা আয়শা (রা.) বলেন, আমি যদি জানতে পারতাম যে, কোন্‌ রাতটি ক্বদর তাহলে আমার বেশিরভাগ দুআ হতো- আস আলুলস্না-হুল আফওয়া ওয়া আফিয়াহ। আমি আল্লহর নিকট ৰমা ও নিরাপত্তা কামনা করছি।মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, দুররে মানসুর ৬ষ্ঠ খণ্ড-৩৭৭ পৃঃ) কাব (রা.) বলেন, লাইলাতুল ক্বদরে যে ব্যক্তি তিনবার লা-ইলা-হা ইলস্নালস্না-হ বলবে প্রথম বার বলার জন্য আলস্নাহ তাকে ৰমা করে দেবেন। দ্বিতীয়বারের জন্য তিনি তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন এবং তৃতীয়বারের জন্য তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
সুতরাং ক্বদরের রাতে উক্ত দুআগুলো অধিকমাত্রায় পড়া তাওফিক দান করুন ।

E-mail: uqfbd@yahoo.com

http://probashbarta.com:

No comments:

Post a Comment